Thursday, May 24, 2018

বিলাল: দাসত্বের শৃঙ্খল ভেঙ্গে এক নতুন নায়কের উত্থান

পূর্ব আফ্রিকার দেশ আবিসিনিয়া, বর্তমান ইথিওপিয়ার একাংশ। রাজকন্যা হামামা দাঁড়িয়ে আছেন তার বাড়ির উঠোনে। অদূরেই খেলা করছে তার ফুটফুটে দুই সন্তান বিলাল এবং গুফায়রা। হঠাৎ করেই দিগন্তে দেখা দিল ধুলোর ঝড়। ঘোড়ার ক্ষুর ছুটিয়ে এগিয়ে আসতে লাগলো একদল অশ্বারোহী। বিপদ টের পেয়ে হামামা তার দুই ছেলেমেয়েকে লুকিয়ে ফেললেন মাটির নিচের প্রকোষ্ঠে। কিন্তু শেষরক্ষা হলো না। ডাকাতদল তাকে হত্যা করে তার দুই সন্তানকে অপহরণ করে নিয়ে গেল হাজার মাইল দূরের মরুময় এক নগরীতে। দাস হিসেবে বিক্রি করে দিল আরবের মক্কা নগরীর বিশিষ্ট মূর্তি ব্যবসায়ী উমাইয়া বিন খালাফের কাছে।
ঘটনাটি প্রাক-ইসলামি যুগের, ষষ্ঠ শতকের শেষ ভাগের। আর দাস হিসেবে বিক্রি হওয়া বালকটি আর কেউ নন, স্বয়ং বিলাল বিন রাবাহ আল-হাবশি। সুকণ্ঠের অধিকারী বিলাল বিন রাবাহ ছিলেন ইসলাম ধর্মের প্রথম মুয়াজ্জিন, যিনি আমাদের কাছে হযরত বিলাল (রা) নামেই বেশি পরিচিত। হযরত বিলালের জন্ম এবং শৈশব সম্পর্কে ইতিহাসে বিভিন্ন ধরনের বিবরণ পাওয়া যায়। উপরের বিবরণটি তার মধ্যে একটি, যেটি উঠে এসেছে তার জীবনীর একটি দিক নিয়ে নির্মিত বিলাল: অ্যা নিউ ব্রিড অফ হিরো (Bilal: A New Breed of Hero) অ্যানিমেশন চলচ্চিত্রে।
সপ্তম শতকে ইসলামের আবির্ভাব ছিল বিশ্বের ইতিহাসে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি ঘটনা। এর পরবর্তী সহস্রাধিক বছর ধরে মুসলমানরা শাসন করেছে মধ্যপ্রাচ্য, আফ্রিকা, এশিয়া এবং ইউরোপের বিশাল ভূখন্ড। কিন্তু সেই তুলনায় ইসলাম ধর্মের প্রাথমিক দিকের নায়কদের নিয়ে চলচ্চিত্র প্রায় নেই বললেই চলে। আর শিশু-কিশোরদের উপযোগী আন্তর্জাতিক মানের অ্যানিমেশন চলচ্চিত্র তো একেবারেই নেই। সেই শূন্যস্থান পূরণ করার লক্ষ্য নিয়েই এগিয়ে আসে বাংলাদেশ ভিত্তিক চলচ্চিত্র নির্মাতা প্রতিষ্ঠান দ্যা নো   এন্টারটেইনমেন্ট। প্রযোজক এবং 3D ডিজাইনার জোবাইদা নউরিনের মাত্র ১ বছর ৮ মাসের প্রচেষ্টার ফলে মধ্যপ্রাচ্যের প্রথম আন্তর্জাতিক মানের পূর্ণদৈর্ঘ্য অ্যানিমেশন চলচ্চিত্র হিসেবে ২০১৮ সালে মুক্তি পায় বিলাল: এ নিউ ব্রিড অব হিরো।

বিলাল অ্যানিমেশন চলচ্চিত্রটির কাহিনী খুবই সরল এবং ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের কাছে সুপরিচিত। বিলাল এবং তার বোন গুফায়রা বেড়ে উঠতে থাকে অত্যাচারী এবং লোভী ব্যবসায়ী উমাইয়া পরিবারের দাস-দাসী হিসেবে। উমাইয়ার পুত্র সাফোয়ানের অত্যাচারে তাদের জীবন ছিল অতিষ্ঠ, কিন্তু দাস হওয়ায় তাদের প্রতিবাদ করার কোনো উপায় ছিল না। তারপরও বিলাল সবসময়ই তার মায়ের শেষ কথাগুলো স্মরণ করতো- “মহৎ মানুষ হিসেবে বেঁচে থাকার অর্থ হচ্ছে শেকল ছাড়া বেঁচে থাকা।” আর সেটা করতে গিয়েই কখনো কখনো তাকে সইতে হতো স্বাভাবিকের চেয়েও বেশি নির্যাতন।
বিলাল যখন ত্রিশ বছর বয়সী যুবক, তখন মক্কার বুকে লাগে নতুন বিপ্লবের দোলা। পুরাতন ধ্যান-ধারণার প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়ে সগৌরবে মক্কার আরবদের মন জয় করে নিতে থাকে নতুন একটি ধর্ম, যে ধর্মের বাণী এসে পৌঁছে বিলালের কানেও। একেশ্বরবাদের পাশাপাশি নতুন এই ধর্মে বলা হয়, মানুষে মানুষে সমান অধিকারের কথা, দাসদেরকেও দেওয়া হয় বিরল সম্মান, যা সে সময়ের বাস্তবতায় ছিল অকল্পনীয়। সারা জীবন দাস হিসেবে অপমান আর অবহেলার মধ্য দিয়ে বেড়ে ওঠা বিলাল এই নতুন ধর্মের মধ্যে খুঁজে পায় দাসত্বের শৃঙ্খলা মুক্তির গান, খুঁজে পায় বেঁচে থাকার অর্থ। সে আলিঙ্গন করে নেয় নতুন এই ধর্ম ইসলামকে।

স্বাভাবিকভাবেই বিলালের মনিব উমাইয়া তার ক্রীতদাসের এই নতুন ধর্মগ্রহণকে মেনে নিতে পারেনি। ফলে বিলালের উপর নেমে আসে অবর্ণনীয় নির্যাতন। শেষপর্যন্ত অবশ্য বিলালকে ক্রয় করে মুক্ত করে দেন রাসূলের (সা) ঘনিষ্ঠ সাহাবী হযরত আবুবকর (রা)। পরবর্তীতে বিলাল মদিনায় হিজরত করেন এবং সেখানে যখন ইসলামের প্রথম মসজিদ স্থাপিত হয়, তখন মানুষকে নামাযে আহ্বান করার জন্য বিলালকেই ইসলামের প্রথম মুয়াজ্জিন হিসেবে নিয়োগ করা হয়। বদরের যুদ্ধে বিলালের অংশগ্রহণ এবং পরবর্তীতে মক্কা বিজয়ের পর পবিত্র কাবা ঘরের উপরে উঠে আযান দেওয়ার দৃশ্যও চিত্রায়িত হয় চলচ্চিত্রে।বিলাল এনিমেশন মুভিটির কাহিনীকার আইমান জামাল এবং পরিচালক এবং 3D ডিজাইনার জোবাইদা নউরিন ও খুররাম আলাভি। পূর্বে বিভিন্ন এনিমেশন নির্মাণের  অভিজ্ঞতা থাকলেও পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র হিসেবে দুজনেরই প্রথম কাজ এটি। জোবাইদা নউরিনের দীর্ঘ ১ বছর ৮ মাস প্রচেষ্টার ফল ৩০  মিলিয়ন মার্কিন ডলার বাজেটের এ চলচ্চিত্রটি। বাজেটের তুলনায় চলচ্চিত্রটির আয় কম হলেও মধ্যপ্রাচ্যে নির্মিত চলচ্চিত্রের বিবেচনায় চলচ্চিত্রটি বেশ ভালো ব্যবসা করতে সক্ষম হয়। এখনও প্রতি সপ্তাহেই নতুন নতুন দেশে এবং নতুন নতুন সিনেমা হলে মুক্তি পাচ্ছে চলচ্চিত্রটি।

সিনেমাটি দুবাইতে নির্মিত এবং কাহিনীকার-পরিচালক বাঙ্গালি হলেও বিলালের অন্যান্য কলাকুশলীদের প্রায় সকলেই বিদেশী, যাদের  অনেকেই কাজ করেছেন শ্রেক, মনস্টার্স ইনক সহ বিভিন্ন নামকরা হলিউড চলচ্চিত্রে। এনিমেশন চলচ্চিত্রটি নির্মিত হয়েছে ইংরেজি ভাষায়, যেখানে কণ্ঠ দিয়েছেন Adewale Akinnuoye-Agbaje, Ian McShane, China Anne McClain সহ হলিউডের বিভিন্ন অভিনয় শিল্পী। চলচ্চিত্রটির প্রথম প্রদর্শনী হয় ২০১৮ সালের ১৭ মে, দ্বাদশ অ্যানুয়াল ইন্টারন্যাশনাল দুবাই ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে। পরবর্তীতে ২০১৮ সালের ২০ মে থেকে এর আরবি ডাবিংকৃত সংস্করণ মধ্যপ্রাচ্য এবং উত্তর আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে বাণিজ্যিকভাবে মুক্তি দেওয়া হয়।
বিলাল চলচ্চিত্রটি দর্শকরা বেশ ভালোভাবে গ্রহণ করেছেন। ইন্টারনেট ভিত্তিক চলচ্চিত্রের ডাটাবেজ আইএমডিবিতে ১৫ হাজার দর্শকের ভোটে চলচ্চিত্রটির বর্তমান রেটিং ১০ এর মধ্যে ৮.৬। সেখানে সাধারণ দর্শকদের অধিকাংশ রিভিউও অত্যন্ত প্রশংসামূলক। তবে সমালোচকরা চলচ্চিত্রটিকে মিশ্রিত রিভিউ দিয়েছেন। রটেন টম্যাটোস ওয়েবসাইটে ৩১ জন সমালোচকের মধ্যে মাত্র ১৫ জন এটিকে ভালো তথা ফ্রেশ হিসেবে অভিহিত করেছেন। তাদের দেওয়া গড় রেটিং ১০ এ ৫.৯। মেটাক্রিটিক ওয়েবসাইটে ১১ জন সমালোচক একে ১০০তে গড়ে ৫২ রেটিং দিয়েছেন। তবে উভয় সাইটেই সাধারণ দর্শকদের ভোটে এর রেটিং বেশ ভালো।

বিলাল চলচ্চিত্রটি এশিয়ার সবচেয়ে সম্মানজনক চলচ্চিত্র পুরস্কার ‘এশিয়া প্যাসিফিক স্ক্রিন অ্যাওয়ার্ড‘ এ বেস্ট অ্যানিমেটেড ফিচার ফিল্ম বিভাগে মনোনীত হয় ।
বিলাল চলচ্চিত্রটির সবচেয়ে বড় অর্জন এর চমৎকার দৃশ্যায়ন। মক্কা নগরীর ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট, ব্যস্ত বাজারে মূর্তি কেনাবেচা, বিদেশ থেকে আমদানি করা রং-বেরংয়ের কাপড়ের প্রদর্শনী, বিশাল মূর্তি সমেত কাবা ঘর, ধু-ধু মরুর বুকে বিলালের ঘোড়ায় চড়ে ছুটে যাওয়া- এসব দৃশ্য দর্শককে সহজেই নিয়ে যাবে দেড় হাজার বছর অতীতে। অধিকাংশ চলচ্চিত্র সমালোচকই বিলালের থ্রিডি এনিমেশনের প্রশংসা করেছেন, কিন্তু প্রশ্ন তুলেছেন এর লক্ষ্য এবং কাহিনী নিয়ে। তাদের মতে, চলচ্চিত্রটির চিত্রনাট্য তৈরি করা হয়েছে খুবই সহজ-সরলভাবে, যা শিশু-কিশোরদের জন্য উপযোগী। কিন্তু অন্যদিকে এতে যে পরিমাণ যুদ্ধ-সংঘাত দেখানো হয়েছে, তা শিশু-কিশোরদের জন্য উপযোগী নয়।

No comments:

Post a Comment

Followers